ভোর ৫টায় ঘুম ভাঙলো আবিরের।ফজরের নামায পড়ে এক কাপ তাজা চায়ের স্বাদ নিতে নিতে নেমে আসলো বাগানে। শীতের সকাল, চারদিকে কুয়াশায় ঘেরা,আবছায়া সব কিছু। বেশ ভাল লাগছে আবিরের।গায়ে পাতলা একটা শাল।কখন যেন সেটাও গা থেকে সরিয়ে দিল।বাগানের সামনের গেট টার দিকে একটু লক্ষ করতেই দেখলো একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে।
নীল পরী নয়,রুপকথার রানীও নয়-দেখতে খুব সাধারন লাগছে। সাধারনের মাঝেই সে অসাধারন -ভাবছে আবির।' একবার ওর কাছে যাই? না,কে না কে! আমাকে উল্টো খারাপ ভাবতে পারে" তাই দুর থেকেই দেখে যাচ্ছে।
ভার্সিটি থেকে রিকসা করে ফিরছে আবির।বিকেল ৪টা।বাড়ির সামনের গেটটা পার হয়ে ওদের প্রধান গেট এ যেতে হয়। বাগানের সামনের যে গেট টা ওটা অচলই পড়ে আছে।অনেক দিন ধরে এই গেট টা কেউ খুলে না,কেউ প্রবেশ করে না আর কেউ বের ও হয় না।
আবির গ্রামের ছেলে, পড়াশুনোর তাগিদে ঢাকায় ২দিন হলো এই নতুন বাসায় বাবা মার সাথে উঠেছে।আবিরের মায়ের ধারনা "ছেলে কে হোস্টেলে দিলে পড়াশুনা তো হবেই না,উল্টো উনি উনার ভাল ছেলে টাকে খারাপ হওয়ার সুযোগ বানিয়ে দিবে" তাই পুরো পরিবারই এখন ঢাকায়।
দুর থেকেই লক্ষ করছে বাগানের গেট টায় কেউ দাড়িয়ে আছে।আরে,এ ত গতকালের সেই মেয়ে টি মনে হচ্ছে"
"এই যে ভাই রিকসা টা একটু সামনে করেই রেখে দিন"
মেয়েটি সত্যি অসাধারন, কিন্তু কাল দেখলাম ওকে একটা সাদা ড্রেস আজও সাদা! মনে হয় ওর প্রিয় রং সাদা,তাই সব ড্রেস সাদা ই" মনে মনে বলছে আবির।মেয়েটার থেকে এক পলক দৃষ্টি সরিয়ে নিল,পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিকসা ওয়ালাকে টাকা দিয়ে যেই মেয়েটারর দিকে তাকালো "যাক বাবা, চোখের পলকে মেয়েটি কোথায় চলে গেল?"
মেয়েটির রুপ লাবন্য প্রশংসনীয়। কিন্তু ও এখানে এসে দাড়িয়ে থাকে কেন? কারো জন্যে কি অপেক্ষা করে? এখন ই বা কোথায় গেল? সামনের আর পেছনের রাস্তা দুইটাই অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে,মেয়েটা এতই দ্রুত চলে! ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরে এলো আবির।
১৬ডিসেম্বর। বন্ধুরা সবাই বিজয় দিবস উদযাপন করছে।আবিরের শরীর একটু খারাপ থাকায় যাওয়া হল না।তখন রাত ৯টা,রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খাওয়া শেষ করে রুমে ফিরলো আবির।এত তারাতারি ঘুম আসবেনা,বন্ধুরা সবাই এঞ্জয় করছে,আর আমি! চারদিক থেকে বিজয়ের গান ভেসে আসছে "একাত্তরের মা জননী, কোথায় তুমার মুক্তি সেনার দল?" আবিরের আর মন টিকলো না ঘরে,হরতরি করে বারান্দায় চলে গেল।বারান্দা থেকে বাগানটা বেশ দেখা যায়,আর শীতের রাতে বাগান টাও বেশ লাগছে।বারান্দায় এসে মন টা ফুরফুরে করে নিল,চারদিক থেকে বিভিন্ন গান ভেসে ভেসে আসছে।হঠাত ই বাগানের গেট টার দিকে নজর পড়লো আবিরের।বাগানের শেষ ভাগে একটা লাল রং এর লাইট জ্বালানো, সব কিছুই লাল দেখাচ্ছে।গেট টার ওপাশে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে,মনে হল তার।"এত রাতে কে ওখানে? হয়ত সব জায়গায় বিজয় উৎসব তাই অনেকেই বাড়ি না ফিরে থাকতে পারে" এটা ভেবে দাড়িয়ে গেল।রাত তখন প্রায় ১১টা,কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে গান শুনছে আবির।চারপাশে চোখ মেলতেই নজরে চলে আসলো সেই মেয়েটি, আজও সাদা ড্রেস। সাদা পরীর কথা কখনো শুনিনি তবে এটাই তো সাদা পরী" চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো।এত রাতে একা একটা মেয়ে এমন নিরব একটা জায়গায় দাড়িয়ে আছে,এটা ত ভাল না,একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করি ওকে। ভেবেই দোড়ে গেল গেট এর কাছে।হাতে টর্চলাইট নিয়ে যাচ্ছে আবির।গেট এর কাছে যেতেই "মেয়েটি কে আর দেখা যাচ্ছে না" পেছন থেকে ডাক শুনা যাচ্ছে "আবির,আবির, কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে?"
আম্মু,তুমি এখনো ঘুমাওনি?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,পানি খেতে উঠে দেখি তুই দৌড়ে বের হচ্ছিস। কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে একা? "
আম্মু,তুমাকে আমি একটা কথা বলবো"
"তোকেও কিছু বলার আছে,আমি আজই জানতে পারলাম, তোর ও জানা উচিত'
কি হইছে? আবির আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো।
"এই বাড়িটা খুব বেশি ভাল না,তুই রাতে একা একা কোথাও বের হস না,আর একটু সাবধানে থাকিস"
কিন্তু কেন?'
"এই বাড়িওয়ালার একটা মেয়ে ছিল, অনেক সুন্দরী দেখতে,বাড়িওয়ালার প্রথম স্ত্রীর কন্যা ছিল।সৎ মায়ের সাথে মেয়েটারর ভাল সম্পর্ক ছিল না।বাড়িওয়ালা দেশের বাইরেই বেশি সময় কাটাতো।সৎ মায়ের সাথে কিছু একটা বিষয়ে ঝগড়া, তর্ক বিতর্ক অনেক দিন ধরেই চলছিল।এক পর্যায় মেয়েটা সহ্য করতে না পেড়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছিলো। যে ই বাগানের গেট টা পার হলো,তখনি বিপরীত পাশ থেকে একটা ট্রাক এর ধাক্কায় মেয়েটা স্পটেই মারা গেল,আর তারপর থেকেই নাকি অনেকেই মেয়েটি কে মাঝে মাঝে ওখানে দেখে থাকে"
আম্মুর কথা শেষ না হতেই "আম্মু মেয়েটি কি সাদা জামা পড়ে সবসময়?"
"যারা দেখেছে তারা এমনি বলে,কিন্তু তুই কি দেখেছিস?"
"না," উত্তরে বললো আবির।আচ্ছা আম্মু যাও এবার অনেক রাত হইছে,ঘুমাতে যাও" বলে আবির তার রুমে ফিরে এলো। কিন্তু মনটা গেট এর বাইরে দাড়িয়ে থাকা সে মেয়েটারর কাছেই রয়ে গেল। 'এটা কি করে সম্ভব? আমি নিজের চোখে ওকে দেখেছি,একজন মৃত মানুষকে আমি বারবার দেখি? এটা হতে পারে না" ঐ দিন সারা রাত আর ঘুম হলো না।
তার কিছুদিন পর বাড়িওয়ালা দেশে ফিরলেন। তিনি অবশ্য ফিরেই আবির আর তার বাবা মা কে সাবধানে থাকার কথা বললেন। তখনই আবিরের বিশ্বাস হলো 'হুম,সত্যিই মেয়েটা আর নেই"
মনের অজান্তে ভাল লাগা সেই সাদা পরী টা আর হয়ত আসবে না।সব কিছু জানার পর সেই সাদা পরীকে ও আর দেখা যায়নি,হয়ত অন্য কেউ দেখেছো কিন্তু আবিরের চোখে আর ধরা পড়েনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন